অর্জিত একাকিত্বের কবিতা (Translating Bryten Brytenbach)

[

ইতিহাসের কাজ আর্কাইভিং, সময়ের আর্কাইভিং। সাহিত্যেরও তো ওই একই কাজ। তাই আমার মতে সাহিত্য আর ইতিহাসে বিশেষ পার্থক্য নেই। আরেকটু বড় করে ভাবলে, অভিনেতা জন-রাইস ডেভিসের কথাটাই ঠিক মনে হয়- ‘পৃথিবীর সমস্ত বিষয়কেই ইতিহাসের চোখ দিয়ে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব।’ বর্তমান কাজটাকেও, পাঠক তেমন এক আর্কাইভিং-এর কাজ হিসাবেই দেখতে পারেন। 

আমরা এখন যে সময়ে ও যে রাজনৈতিক পৃথিবীতে বসবাস করি, সেখানে করোনার মতোই ফ্যাসিবাদ নামক ভাইরাসের এক অদ্ভুত মিউটেশান রাজনীতির নামে বিশ্ব-মানবিকতাকে গিলে খেতে বসেছে। বিগত এক দশকে, দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র, ক্ষমতার এই অশ্লীল দলন-চক্র স্বাধীন মেধার কলম রোধে উন্মত্ত হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৮, এই ছয় বছরে তুরস্কের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় আমার নিজের চোখে দেখা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি কীভাবে নোবেল পুরষ্কার প্রাপক স্বাধীনচেতা (আমার কলেজ জীবনের নায়কদের মধ্যে অন্যতম একজন) এক লেখক, ক্ষমতার দালালে রূপান্তরিত হয়েছেন। সেদিন লজ্জায়-ঘেন্নায় আমরা অনেকেই সভা ছেড়ে উঠে এসেছিলাম – পরে অবশ্য বুঝেছি তেমনটা না করলে তাঁর অবস্থা বর্তমান ভারতবর্ষের ভারভারা রাদের মতোই হত।

এখন ব্যাপার হল, বিজ্ঞানের মতোই একটা নির্দিষ্ট সামাজিক তথা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানও ইতিহাসের পাতার কোনো এক অপাঠিত কোণে চাপা পড়ে থাকে। আসলে মানব বিবর্তনের সাইনুসয়েড এতই দীর্ঘায়িত যে, সমসাময়িক সভ্যতার উজ্জ্বল শিখর অথবা আধার-বর্ণ খাতের কোনোটির পদাঙ্কই বিশেষ নতুন কিছু নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই তেমন ধারার একাধিক উদাহরণ মেলে। হ্যাঁ, অবশ্যই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব ধারার পরিপ্রেক্ষিত বদলায়। কাজেই বিজ্ঞানের মতোই সে ধাঁধার সমাধান সাধারণত হারানো ইতিহাসেই পাওয়া যায়। ভারতবর্ষ তথা বর্তমান বিশ্বের সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতের সিমিলি খুঁজতে বসে, বিগত বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা পড়াশোনা শুরু করি আমি। সে সূত্রেই সাহিত্যিক, কবি ও চিত্রকর Breyten Breytenbach- নামটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে।

ব্রায়টেন ব্রায়টেনবাখের জন্ম ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে, কেপটাউন থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ আফ্রিকার বোনিভাল গ্রামে। বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা ও সরাসরি রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে আপার্থাইড সরকার তাঁর নামে সমন জারি করে এবং ফলত ষাটের দশকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে প্যারিসে চলে যেতে বাধ্য হন ব্রায়টেনবাখ।  সেখানে তিনি ভিয়েতনামের বংশোদ্ভূত এক ফরাসি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং মিশ্র বিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইনের কারণেও সে সময়ে দেশে ফিরে যেতে পারেননি। 

১৯৭৫ সালের ১৯শে আগস্ট, Christian Marc Galaska এই ছদ্মনামে প্যারিস থেকে লুকিয়ে দেশে যাওয়ার পথে Jan Smuts বিমানবন্দরে ধরা পড়েন ব্রায়টেনবাখ, এবং উচ্চতর দেশদ্রোহিতার দায়ে নয় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তবে শেষ অবধি তাকে সাড়ে সাত বছরের কারাজীবন কাটাতে হয়েছিল, যার প্রথম দু’টি বছর ছিল Pretoria Maximum Security জেলের ফাঁসি কক্ষের সামনের একটি বদ্ধ ঘরে একাকি নির্জন কারাবাস। সে সম্বন্ধে ব্রায়টেনবাখ তার "True Confessions of An Albino Terrorist" বইতে নিজেই বলেছেন-

‘Beverly Hills the place is called in prison parlance.  It’s a prison for Blacks essentially though a few Whites are kept there too.  I sensed that first night, and it was confirmed later on, that this was the place of death; this is the shameful place to which people are brought to be killed legally and in cold blood by representatives of the State.  I saw so much.  With the ears only, since the eyes are confined by bars and walls and steel partitions never more than seven yards away.  The whole place is impregnated by this one overriding function:  this is the reality of Maximum Security Terminus. Death House.  (1984:31)

১৯৭৭ সালে আরো কিছু অপরাধের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালায় সরকার- কিন্তু বিশেষ কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। অবশেষে, আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের ফলস্বরূপ ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ব্রায়টেনবাখ প্যারিসে ফিরে আসেন এবং ফরাসী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল পার্টির পতন ঘটে এবং বর্ণবাদ-আইনের সমাপ্তি ঘটে। ব্রায়টেনবাখ ২০০০ সালের জানুয়ারিতে কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হন। তাছাড়া তাঁর চিত্রকর্ম এবং প্রিন্টের প্রদর্শনী জোহানেসবার্গ, কেপটাউন, হংকং, আমস্টারডাম, স্টকহোম, প্যারিস, ব্রাসেলস, এডিনবার্গ এবং নিউইয়র্ক সিটি সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর সঙ্গেও জড়িত। 

পুরস্কার: জিবিগিনিউ হারবার্ট আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭।

কারাবাসের প্রলম্বিত বছরগুলিতে কবি প্রায় ৪০০ কবিতা রচনা করেছিলেন। সে সময়ের প্রায় সমস্ত কবিতাই আফ্রিকানাস ভাষায় রচিত। তাই আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে আরো বেশি করে পৌছনোর সুবিধার্থে Denis Hirson এবং ব্রায়টেনবাখ নিজে, ১৯৮৮ সালে ‘Judas Eye and Selfportrait/Deathwatch’ নামে তেষট্টিটি কবিতার একটি সংকলন প্রকাশ করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য সে বই এখন আর ছাপা হয় না। তাছাড়াও সে কাজে কবি ও অনুবাদক সাময়িক ধারার মোটেই খেয়াল রাখেননি- কবির খেয়াল, আমি আপনি বলার কে! কাজেই ব্রায়টেনবাখকে নিয়ে আমার পড়াশোনা থমকেই যেত যদি না ‘POETRY IN PRISON. A STUDY OF BREYTEN BREYTENBACH’S FIVE VOLUMES OF PRISON POETRY IN TRANSLATION’ নামক একটি থিসিস আমার হাতে না এসে পৌছতো। সে থিসিসে কারাবাসকালীন সাময়িক ধারায় লেখা বেশ কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদের খোঁজ পাই। সে কবিতাগুচ্ছের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ দু’টি পত্রিকায় প্রকাশ করার সুযোগ ঘটেছে। 

সেই অনুষঙ্গই “অর্জিত একাকিত্বের কবিতাঃ বাংলা অনুবাদে কবি ব্রায়টেন ব্রায়টেনবাখ“ নামক এই ধারাবাহিক। ‘হ্যালো টেস্টিং বাংলা কবিতা’র অনুপ্রেরণায় সেই থিসিসে প্রকাশিত আরো বেশ কিছু কবিতার বঙ্গানুবাদ আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়ার সুযোগ ঘটেছে।

ব্রায়টেনবাখের লেখনির যে নিজস্ব ধারা রয়েছে তার অনেক জায়গাতে স্বভাবতই আফ্রিকানাসের নিজস্ব শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে নিওলজিজমের (Neologism) অবাধ প্রয়োগ, যা আক্ষরিক অনুবাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে। সময়ে অসময়ে তেমন সমস্যার সম্মুখীন হলেও, লেখাগুলোর যথাযথ কাব্যিক ও অর্থবহ ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। তাই সবশেষে এ কাজের তুল্যমূল্য বিচার আপনারা, আমার পাঠকরাই করবেন। এই রাজনৈতিক অরাজকতার পৃথিবীতে ব্রায়টেনবাখ সাহেব আমাদের পথ দেখাবেন সেই কামনাই করি।

ভাষানগর

ভোরের সাঝপথ

বোবাযুদ্ধ (আসানসোল)



প্রবন্ধ ঃ হারানো স্বাধীনতা ও অর্জিত একাকিত্বের কবিতা