আশীষদার সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় উৎস মানুষ সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে তারই বাড়িতে হওয়া এক আড্ডায়। জুলাই, ২০২১, ওয়াই হাউজ-এ। সে আড্ডায় আমি এক বোতল ফরাসি ওয়াইন নিয়ে গিয়েছিলাম। আশীষদা খাননি, তবে ওপেনার না থাকা সত্ত্বেও স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে আমার কর্ক খোলার কেরামতি দেখে বেশ উচ্ছসিত হয়েছিলেন। আমিও তার প্রবন্ধের ফ্যান-বয় হিসাবে বেশ গদ গদ হয়েছিলাম। খানিক ফিশ ফ্রাই, খানিক জলপানের মধ্যে আমার ইস্তানবুলে থাকার অভিজ্ঞতার কথা শুনে উৎসাহিতও হন। গল্প শুরুও হয়, তবে আমার বেরোনোর তাড়ায় সেই নির্দিষ্ট আড্ডা আজও বাকি থেকে গেছে।
সেবার ফ্রান্সে ফিরে, আমাদেরই একটি বিজ্ঞান পোর্টালের জন্য একটা লাইভ আড্ডার ব্যাবস্থা হয়, ফেসবুকে। আমরা দুজন সঞ্চালক, সেই লাইভে আশীষদার সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘন্টা কথা বলি। জনা তিরিশেক দর্শকও ছিলেন। কথা কথায় বিজ্ঞান, সাহিত্য ছাড়িয়ে বার বার রাজনীতি চলে আসছিল। আমি দেখছিলাম, মানে মুখে কিছু না বললেও খেয়াল করছিলাম, ওনার চিন্তার বেশ কিছু স্তরের সঙ্গে নিজের ভাবপ্রবাহের মিল থাকলেও বিভিন্ন মোড়ে বার বার ঠোকাঠুকি লাগছে। বিজ্ঞানের প্ল্যাটফর্ম বলে কিছু বলতেও পারছিলাম না… অস্বস্তি! যার লেখা পড়ে বাংলা ভাষায় কীভাবে যুক্তিকে জায়গা দিতে হয় শিখেছি, তার দর্শন ও রাজনীতির সঙ্গে কিছু মননশীল সংঘাতের লোভটা সেই লাইভ আড্ডাতেই আমায় পেয়ে বসে।
আশীষ দা বলেছিলেন ওনার জীবনের তিনটি টার্নিং পয়েন্ট হল, রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স এবং নকশালবাড়ি আন্দোলন। কাজেই নিজের কিছু পড়াশোনা থাকলেও, এই বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার “প্রস্তুতিপর্ব” বেশ দীর্ঘ ছিল। সে সময়টায় আমরা ওনার অনুবাদ পদ্ধতি, বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান-সিউডোসায়েন্স লবি ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেছিলাম। সেগুলো বঙ্গ পাঠক সমাজে খানিকটা সমাদ্রিতও হয়, এবং অবশ্যই গালাগালিও কুড়োয়। এরপর আসে বিবেকানন্দ ও বাঙালির সেকুলারিজম-এর পালা। সেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকার অনেককেই উত্তপ্ত ও বিরক্ত করেছিল, করারই কথা। সব শেষে রবীন্দ্রনাথ, এবং আশীষ দা আর ওনার সুহৃদদের রাজনীতি এবং সত্তর দশক।
এই আড্ডাগুলোর বেশিরভাগই, হয় ফেসবুক লাইভে বা লিখিত আকারে কোনো না কোনো ছোটো কাগজের ব্যানারে বেরিয়েছে। লিখিত আকারের কোনো কোনোটা আংশিক প্রকাশিত। প্রথম দুটো সাক্ষাৎকার যেমন বিজ্ঞান.ওআরজি.ইন-এর তরফে হওয়া সেই লাইভ আড্ডারই লিখিত ও সম্পাদিত সংস্করণ। এছাড়া গুরুচণ্ডালী, সাম্পান, ইন্সক্রিপ্ট.এমই, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের মত জনপ্রিয় ওয়েব পোর্টাল ও লিটল ম্যগাজিনগুলিকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই আড্ডা-গুচ্ছের থেকে আমার টেক-এওয়ে অগুনতি। বাবা চলে গেছে ২০০৫ সালে, আমি সবে কলেজ, তাই সে বয়সে বাবাদের প্রজন্মের স্বপ্ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক এ্যাস্পিরেশানগুলো বাবার কাছ থেকে বুঝতে ওঠার সুযোগ পাইনি। আশীষদার সঙ্গে হওয়া গপ্পোগুলোয় সেই জায়গাটা আমার এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। চিন্তা ভাঙে, চিন্তা গড়ে, আশীষদাই বলেন; বেশ খানিকটা ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে গেলাম আমিও। তাছাড়া দর্শন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ও রাজনীতি বিষয়ক হাজারো প্রশ্নের কখনও মনমত, আবার কখনও অমনমত ব্যাখাও পাওয়া হল। ডায়ালেক্টিক্স… সেও খানিকটা প্রাপ্তি।
সবশেষে, 'আর্ট অফ ইন্টারভিউয়িং' নিয়ে দুটো কথা। ওরিয়ানা ফালাচি, যার “Interviews with History and Conversations with Power” বইটা আমার মত কথোপকথন-প্রিয় বহু ছাত্র-ছাত্রির কাছেই একপ্রকার ডকট্রিনের মত; ফালাচি, যার নেওয়া সাক্ষাৎকারকে হেনরি কিসিঙ্গার অবধি নিজের জীবনের বৃহত্তম ভুল হিসাবে স্বীকার করে গেছেন; ফালাচি, যিনি ইরানের খোমেনির সামনে তার নিজের ডেরায় মাথার স্কার্ফ ছুড়ে দিয়ে আসার বুকের পাটা দেখাতে পেরেছিলেন, গুলি খেয়েছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের কভারেজে, তার কথায় “Interviewee must be an intellectual adversary”। আশীষদা এতদিনে নিশ্চই বোঝেন যে আমি কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই পাঠক এই বইতে ঝগড়ার অন্ত পাবেননা। তাছাড়া, আশীষদাকে কথায় কথায় একবার বলেছিলাম, “একজন মানুষের এক জীবনে আর কত নতুন কথা বলার থাকতে পারে?” স্বীকার করি ওটা ইন্সটিগেশান; খোঁচা! সে পদ্ধতিও ফালাচি মাদামেরই বাতলে দেওয়া। আশা করি এতদিনে আশীষদা সেটাও ঠাওর করে ফেলেছেন… এবার নিজগুণে মাফ করে দিলেই হয়।
বাকি সমস্ত কথাই রইল এই বইয়ের অন্দরমহলে… আড্ডাপ্রিয়, দ্বন্দ্বপ্রিয় বাঙালি পাঠকের করকমলে।
প্রসঙ্গ "বিবেকানন্দ": চিন্তা ভাঙে, চিন্তা গড়ে
প্রসঙ্গ "রবীন্দ্রনাথ"
প্রসঙ্গ "বুদ্ধিজীবী"
প্রসঙ্গ: বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি
প্রসঙ্গ- অনুবাদ:





